একাত্তরের কালো প্রচ্ছদ
লেখিকাঃ লাবণ্য কান্তা
ধরণঃ মুক্তিযুদ্ধ বিষয়ক/মুক্তিযুদ্ধের স্মৃতিচারণ
প্রকাশনীঃ শিল্পতরু প্রকাশনী
প্রথম সংস্করণঃ ফেব্রুয়ারী, ২০১২
মূল্যঃ একশত টাকা (মাত্র)
বাংলাদেশের প্রেক্ষাপট নতুন করে বলার নেই। যা ঘটেছে তা আমরা; আমাদের সমাজ প্রত্যক্ষ করেছি। স্মৃতির অতল গহ্বরের জং ধরা অংশে সামান্য টোকা আমাদের অন্তঃচক্ষু খুলে দিতে পারে। তেমনই লেখিকা লাবণ্য কান্তা'র পরিমার্জিত উপহার ‘একাত্তরের কালো প্রচ্ছদ’ বইটি। মনের সাথে মুক্তির গন্ধ বইটির পরতে পরতে ছড়িয়ে…
আসলে একাত্তর কি?
- পৃথিবীর খন্ডকাব্য হয়তো, নয়তো বিস্তৃত ইতিহাস!
ঘটনাপ্রবাহ- ১
২০১১ সালের ২৫শে মার্চ রাত। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের নাট্যকলা বিভাগের ছাত্ররা উপস্থাপন করেছিলেন জগন্নাথ হলের সেই বর্বর ও বেদনাবিধুর ঘটনা; নাটকের সত্যতা হয়ে। এরপর বধ্যভূমির পাশে উপস্থাপনা হয়। সেখানে নাট্যব্যক্তিত্ব জয়ন্ত চট্টোপাধ্যায়, বিশ্ববিদ্যালয় ভিসি ডঃ আ আ ম স আরেফিন সিদ্দিকী, কবি অসীম সাহা, কবি নির্মলেন্দু গুণসহ অনেকেই স্মৃতির বর্ণনা দেন। লেখিকা বুকে পাথরের ভার নিয়ে সে সব স্মৃতির সাক্ষী হন। কবি অসীম সাহা এবং নির্মলেন্দু গুণের বন্ধুবিয়োগ এবং বেদনার স্পর্শ পাওয়া যায়। অতীতে ফিরে যান লেখিকা; হারানো স্মৃতি কবি কাসেমের বন্ধু হয়ে। এরপর মুক্তিযোদ্ধাদের যুদ্ধ, সাহায্য, জীবন একে একে চলে আসে পৃষ্ঠাভর।
ঘটনাপ্রবাহ- ২
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের চতুর্থ শ্রেণীর কর্মচারী ছিলেন মনভরণ। প্রেম করে, পরিবারের অনিচ্ছায় প্রথমে বিয়ে করলেও পরে এক নার্সের মাধ্যমে বোঝাপড়ায় মেনে নেন ওনার পরিবার। মনভরণের পত্নীর নাম ছিল রাজকুমারী দেবী। মূলত ওনাকে নিয়েই এই বইয়ের এক তৃতীয়াংশ। যুদ্ধ শুরু হওয়া অর্থাৎ ২৫শে মার্চের কালো রাত থেকে যে দুর্বিষহ জীবন পার করেছেন তা উল্লেখিত। রাজকুমারী দেবী প্রথমে ভাসুর হারায়, এরপর স্বামী। নিরুদ্দেশ হয়ে যাত্রা মায়ের বাড়ি। সেখানে কিছুদিন থাকার পর নরপিশাচদের অস্তিত্ব টের পেয়ে অপরিচিত কৃষকের বাড়িতে আশ্রয় নেওয়া। বন্যায় কবলিত হওয়া। সেখান থেকে ঘুরেফিরে উদ্ধাস্তু শিবিরে আশ্রয়। তাদের সঙ্গী হওয়া। এরপর কোন এক চেয়ারম্যানের সাহায্যে আবার শাশুড়ি-সন্তান নিয়ে ঢাকা আগমন। বেচেঁ থাকার লড়াই। পরিশেষে স্বামীর কঙ্কালসার মৃতদেহ আবিস্কার করেন জগন্নাথ হলের ঝুপড়ির স্তুপ থেকে। …স্পষ্টত রাজকুমারী দেবীর বর্ণনা সত্যিই চোখে জল, বুকে ব্যথা জমিয়ে দেয়।
সুপাঠ্য লেখুনি এবং সম্ভাবনাময় লেখিকাদের মধ্যে লাবণ্য কান্তা অদ্বিতীয়া। একজন কবি, গদ্যকারের ভূমিকায় অতুলনীয়। লেখার শুরুতেই কবি কাসেমের মর্মস্পর্শী বিদায় নিয়ে অসীম সাহার বক্তব্যে স্টেজে বসেই লিখে ফেললেন কবিতা। এর কিছু লাইন ছিল এরকম যা বইতে উল্লেখিতঃ
‘‘২৫শে মার্চের কালো রাতে পাকসেনারা তার রক্ত পান করে,
বুকটা ঝাঁঝরা করে দিয়েছিল একহাটু ঘাসে।
আজ কালো রাতের পাশে এসেছি,
কবি কাসেমের কথা শুনছি।’’
লেখার পয়েন্ট টু পয়েন্ট সত্যিই ভালো লাগার মতো। প্রথমে নাটকের সাথে প্রাণের মিল খুঁজে আলোর পরশ নেওয়া। হৃদয়ে মুক্তিযুদ্ধের অস্তিত্ব ও অতীত ভরণপোষণ সত্যিই চমৎকার। পরিমিত ভাষাবোধ মুগ্ধ করে অনেকখানি। দ্বিতীয়ত, রাজকুমারী দেবীর বর্ণনা সাজিয়ে লেখা দুরূহ। যেহেতু এটি বাস্তব ঘটনা। তাছাড়া বর্ণনা শোনার পরে তা একটু ভুল হলেই লেখার মান নিন্মপর্যায়ের হয়ে যেতো, সেটুকু আগলে নিয়েছেন লেখিকা। সত্যিই প্রশংসনীয়।
আর ভুল বলতে তেমন কিছুই নেই। শ্রেণীবিভাগে করতে গেলে একটু কৌশল এবং প্রয়োগ বিদ্যার ভুল আছে হয়তোবা। সেটুকু পাঠক আর পাঠ্যনীতিতে সীমাবদ্ধ থাকলেই হয়। কবি,লেখিকা লাবণ্য কান্তা মুক্তমত প্রদর্শন করে অনেককেই চিনতে সাহায্য করেছেন। রাজকুমারী দেবীর ঘটনাক্রম ‘মসজিদের ইমাম’ কিংবা ‘সুইপার নেতা’র পরিচয় ঘটিয়ে দিয়েছেন লেখিকা। এসব নাম হয়তোবা হারিয়ে যেতো কালের বিবর্তনে-অনাদরে। হারায়নি।
কবি কাসেম হারিয়েও যেমন আমাদের মাঝে আছেন, তেমনটিই থাকবেন সকল মুক্তিযোদ্ধারা। প্রাণ উৎসর্গ করা মানুষগুলো। লেখিকাকে নিরুঙ্কুশ সাধুবাদ।
• সিয়ামুল হায়াত সৈকত
(রাজশাহী থেকে প্রকাশিত ঢোপকল ম্যাগাজিনের ৮ম অনিয়মিত সংখ্যায় প্রকাশিত)